কুষাণ সাম্রাজ্য

আদি ইতিহাস [Kushana Invasion] :

  • মৌর্য সম্রাজ্যের পতনের পর ভারতে যে রাজনৈতিক শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছিল তা পূরণ করে দক্ষিণ ভারতে সাতবাহনরা এবং উত্তর ভারতে কুষাণরা।
  • চিনের উত্তর-পশ্চিম অংশে ইউ-চি নামে এক যাযাবর জাতি বাস করত। হিউঙ-নু নামে অপর এক যাযবর জাতির তাড়া খেয়ে তারা সিরদরিয়া নদীতীরবর্তী অঞ্চলে এসে সেখান থেকে শকদের বিতাড়িত করে বসবাস করতে শুরু করে ।
  • কিন্তু হিউঙ-নুরা এই অঞ্চল থেকেও তাদের উৎখাত করায় তারা আবার শকদের  (যারা ইতিপূর্বে তাদের তাড়া খেয়ে ব্যাকট্রিয়ায় বসতি স্থাপন করেছিল)  ব্যাকট্রিয়া থেকে উৎখাত করে । শকেরা বাধ্য হয়ে ভারত আক্রমণ করে ।
  • ব্যাকট্রিয়ায় আসার পর ইউ-চিদের দলগত সংহতি বিনষ্ট হয় ও তারা পাঁচটি পৃথক শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। কুষাণরা ছিল এই পাঁচ গোষ্ঠীর অন্যতম ।
  • কুজল কদফিসেস নামে জনৈক ইউ-চি ঐ পাঁচটি গোষ্ঠীকে পুনরায় ঐক্যবদ্ধ করেন ও ভারতে প্রবেশ করে কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রতিষ্ঠা করেন।

উপাদানঃ

  • চৈনিক গ্রন্থ
  • পানকু রচিত "প্রথম হান বংশের ইতিহাস"
  • নাগার্জুন রচিত- মাধ্যমিকাসূত্র
  • অশ্বঘোষ রচিত বুদ্ধচরিত

কুজল কদফিসেস

  • কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রথম রাজা
  • কাবুল ও কান্দাহার জয় করেন
  • হিন্দুকুশ পর্বত পেরিয়ে ভারতে প্রবেশ করেন
  • ওয়াং বা রাজা উপাধি গ্রহণ করেন
  • নিজ নামে স্বর্ন মুদ্রা প্রচলন করেন

বিম কদফিসেস

  • কুজুল কদফিসেস মারা গেলে তাঁর পুত্র বিম কদফিসেস রাজা হন ।
  • ভারতের মূল ভূখণ্ড গাঙ্গেয়-যমুনা উপত্যকায় সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করায় বিম কদফিসেসকে ভারতে কুষাণ সাম্রাজ্যের প্রকৃত প্রতিষ্ঠাতা বলা হয়।
  • তিনি শৈব ধর্মে দিক্ষিত ছিলেন।
  • কুষাণ সম্রাট বিম কদফিসেস ভারতে প্রথম স্বর্ণমুদ্রার প্রচলন করেন।

কণিষ্ক[Kanishka] :

  • কণিষ্ক ছিলেন কুষাণ বংশের শ্রেষ্ঠ রাজা ।
  • ৭৮ খ্রিস্টাব্দে “শকাব্দ” নামে যে বর্ষগণনা শুরু হয়, কণিষ্ক ছিলেন তার প্রবর্তক । এই সূত্র অনুসারে কণিষ্ক ৭৮ খ্রিস্টাব্দেই সিংহাসনে আরোহণ করেন বলে ধরা হয়।
  • উপাধি- মহারাজা(ভারতীয়), রাজাধীরাজ(পার্সীক) এবং দেবপুত্র(চৈনিক)।
  • হিউয়েন সাঙের (বা সুয়ান সাঙের) মতে কণিষ্কের বিশাল সাম্রাজ্যের রাজধানী ছিল পুরুষপুর বা বর্তমান পেশোয়ায় ।
  • বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত তথ্য থেকে মনে হয় কণিষ্কের সাম্রাজ্য উত্তরে কাশ্মীর থেকে দক্ষিণে সাঁচী ও পশ্চিমে সিন্ধু উপত্যকা থেকে পূর্বে বারাণসী পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল।
  • বুদ্ধচরিত রচয়িতা অশ্বঘোষ (সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম প্রধান লেখক), বৌদ্ধ দার্শনিক নাগার্জুন, বৌদ্ধসাহিত্যিক বসুমিত্র, স্বনামধন্য চিকিৎসক চরক, স্থপতি এজেসিলাস রাজনীতিবিদ মাথর প্রভৃতি মনীষীগণ তাঁর রাজত্ব কালেই আবির্ভুত হয়েছহিলেন।
  • ‘চরক-সংহিতা’ এবং ‘সুশ্রুত-সংহিতা’ এই যুগেই সংকলিত হয়। অস্ত্রোপচারের পথিকৃৎ ছিলেন সুশ্রুত।
  • তিনি অসংখ্য বৌদ্ধ বিহার, স্তুপ ও চৈত্য নির্মাণে উদ্যোগী হয়েছিলেন । তাঁরই সময়ে সারনাথ, মথুরা, গান্ধার ও অমরাবতীতে চারটি পৃথক শিল্পরীতির আবির্ভাব ঘটেছিল।
  • তিনি ভারতের বাইরে পার্থিয়ান ও চিনদের পরাজিত করেন এবং কাশগড়, ইয়ারখন্দ ও খোটান অধিকার করেন ।
  • তিনি নিজে বৌদ্ধ ধর্ম গ্রহণ করেন ও পুরুষপুরে একটি বহতল চৈত্য নির্মাণ করেন । অশোকের পর তাঁর সময়েই বৌদ্ধধর্ম পুনরায় রাজানুগ্রহ লাভ করে । তাঁর সময়ে বৌদ্ধধর্ম হীনযান ও মহাযান- এই দুই ভাগে ভাগ হয়ে যায় । তাঁর প্রচেষ্টায় বৌদ্ধধর্ম ভারতের বাইরে খোটান, চিন, জাপান ও কোরিয়ায় ছড়িয়ে পড়ে । স্মিথের মতে, বৌদ্ধধর্মের ইতিহাসে কণিষ্ক ছিলেন দ্বিতীয় অশোক ।
  • হীনযান ও মহাযান এই দুই বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের মধ্যে মতভেদ দূর করার জন্য তিনি চতুর্থ বৌদ্ধসঙ্গীতির আহ্বান করেন। বসুমিত্র, অশ্বঘোষ, নাগার্জুন এই অধিবেশনে অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রায় তিনমাস চলেছিল এই অধিবেশন। এই দীর্ঘ সম্মেলনে সঙ্কলিত ত্রিপিটকের ব্যাখ্যা করেন বসুমিত্র। এই ব্যাখ্যা মহাবিভাষা নামে পরিচিত। কাশ্মীর, জলন্ধর অথবা কান্দাহারে এটি অনুষ্ঠিত হয়েছিল। এটিই ছিল শেষ বৌদ্ধ সম্মেলন।

কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন

  • কণিষ্কের মৃত্যুর পর ধীরে ধীরে কুষাণ সাম্রাজ্যের অবক্ষয় শুরু হয় । বিশিষ্ক, হুবিষ্ক, দ্বিতীয় কণিষ্ক, প্রথম বাসুদেব, তৃতীয় কণিষ্ক, দ্বিতীয় বাসুদেব প্রমুখ পরবর্তী রাজারা ছিল খুবিই দুর্বল। এই সুযোগে অসংখ্য আঞ্চলিক বিদ্রোহ সংগঠিত হয় । উত্তরপ্রদেশে নাগ ও মাঘ বংশীয় রাজারা পাঞ্জাবে বৌধেয় প্রমুখরা বিদ্রোহে শামিল হয় । পশ্চিম ভারতে শকগণ স্বাধীনতা লাভ করে ।
  • পারস্য সাসানীয় বংশের উত্থান ও খ্রিস্টীয় চতুর্থ শতাব্দীতে গুপ্ত সম্রাটদের আক্রমণে কুষাণ সাম্রাজ্যের পতন সুনিশ্চিত হয়।